Slider

Recent Tube

History

Article

Sheikh Mujibur amp; Rahman

Liberation War

Joy Bangla Movement

Media

মুক্তিযুদ্ধের বিরল ইতিহাস

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চুড়ান্ত বিজয়ের পর বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে ছিল এক খাঁদের কিনারায়। নয় মাসের যুদ্ধে দেশের আইন-শৃংখলা, প্রশাসন, অর্থনীতি, অবকাঠামো সবকিছুই ভেঙ্গে পড়েছে। দেশের সর্বত্র ছিল এক অরাজক অবস্থা।  জাতীয় অর্থনীতিতে দেশের মোট উৎপাদনের শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ পণ্য উৎপাদিত হত কৃষি খাত থেকে। যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের প্রাণ হিসাবে পরিচিত সেই কৃষিখাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সর্বাত্মক যুদ্ধে সোনার বাংলার সবই পুড়ে ছারখার হয়, কৃষি উৎপাদনের সব উপকরণ হয় বিনষ্ট; Image source: The Daily Star

যুদ্ধের পরে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের চালানো জরিপ অনুসারে, যুদ্ধকালীন সময়ে চাষাবাদের কাজে ব্যবহৃত পশু, চাষের উপকরণ, বীজ ইত্যাদি ধ্বংস হয়েছে। পাক বাহিনী মাইলের পর মাইল উর্বর ভূমিতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এর ফলে প্রায় ৪.৩ বিলিয়ন টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছিল, যা মোট জাতীয় উৎপাদনের ত্রিশ শতাংশ। বিশেষ করে পাট এবং পাটজাত দ্রব্য ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। রপ্তানি আয়ের আশি শতাংশ অর্থাৎ ৩০০ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার আসতো পাট থেকেই। পাটের গুদাম ধ্বংস, পাটকলের ক্ষতিসাধন, অকেজো বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের কাছে পাটশিল্পকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা পরিণত হয় প্রধান চ্যালেঞ্জে। 

পাটের পাশাপাশি বাংলাদেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী পণ্য চায়ের উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। ১৯৭০-৭২ সালে চায়ের উৎপাদন এক তৃতীয়াংশ কমে দাঁড়ায় ছাব্বিশ মিলিয়ন পাউন্ডে। রপ্তানি বাজার সংকুচিত হয়ে আসে। রাস্তাঘাট, অবকাঠামোর ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে থাকা বন্দর ব্যাপকভাবে আমদানি-রপ্তানি কাজকে ব্যাহত করে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি বড় অংশ দখল করে আছে গেরিলা যুদ্ধ। এই গেরিলা যুদ্ধের কারণে নদীমাতৃক দেশের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় তিনশত সেতু ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। স্বাধীনতার পরে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে মালামাল পরিবহণ করার কাজটিও দুঃসাধ্য হয়ে যায়। এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ২৪৭টি রেল ব্রীজের ১৯৪টিকে মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা হয় জানুয়ারীর তিন তারিখ নাগাদ। রেল যোগাযোগ সীমিত আকারে শুরু হয় তবে বড় ব্রীজগুলো মেরামত করতে আরো ছয় মাসের মতো সময় লাগে।

শুধু হার্ডিঞ্জ ব্রীজ নয়, মুক্তিযুদ্ধের পর দেশজুড়ে শত শত সেতু-কালভার্ট-ব্রীজের অবস্থা ছিল এমন; Image source: Age Fotostock

তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল খাদ্যসামগ্রীর অভাব দূর করা, যেকোনো মূল্যে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের ঘাটতি দাঁড়ায় চল্লিশ লক্ষ টন। তাই সদ্য স্বাধীন এই দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন ছিল বিদেশী বিভিন্ন দেশের সাহায্যের। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের দরকার ছিল খুব সুচারু একটি পররাষ্ট্র নীতি। তাই স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষতা, সবার সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঘোষণা দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান জানায়। বিশ্বের সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করায় ১৯৭২ সালের ১ জুনের মধ্যে ৭৫টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাহাত্তরের শেষ নাগাদ সেই সংখ্যা ৯৪টিতে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা লাভের একদম শুরু থেকেই প্রভাবশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন আর প্রতিবেশী ভারত এই দুইটি দেশ বরাবরই বাংলাদেশকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কূটনৈতিক মহলে সেই সহায়তার অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে তবে শিশু বাংলাদেশের বেঁচে থাকার জন্য এই পদক্ষেপগুলো অনেক জরুরী ছিল। ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ গৃহীত হয় বাংলাদেশ আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি করতে মস্কো যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; Image source: rbth.com

সোভিয়েত বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া চট্টগ্রাম বন্দরকে সারিয়ে তোলা হয়, ভারতীয় নৌবাহিনী ভাসমান মাইন সরানো এবং অবরুদ্ধ নৌপথ মুক্ত করতে সহায়তা করে। বাইরের দেশের সাথে বাণিজ্য করতে বন্দরকে কার্যকর করার কাজ এভাবেই শুরু হয়। এছাড়াও সোভিয়েতের অর্থনৈতিক সহায়তায় ঘোড়াশালে ১১০ মেগাওয়াটের তাপ-বিদ্যুত কেন্দ্র এবং সারাদেশে আটটি রেডিও স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

সব মিলিয়ে ১৯৭২ সালের শুরুর দিকেই প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৬১২ মিলিয়ন ডলার, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের পুরোটার হিসেবে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৮৮৬ মিলিয়ন ডলার। খাদ্য সমস্যা সমাধানে হাত বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন দেশ, ৭২ সালে বিদেশ থেকে আসে তিন মিলিয়ন টন ধান আর গম।

তবে দেশজুড়ে সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল আইন শৃঙ্খলা সমস্যা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও সাধারণ মানুষের সহায়তায় গড়ে উঠেছিল গণবাহিনী। গণবাহিনীতে ছিলেন সাধারণ কৃষক, মধ্যবিত্ত চাকুরে, দিনমজুর, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র। সব মিলিয়ে এই গণবাহিনীর সংখ্যা ছিল ৮৪,০০০। গণবাহিনীর বাইরে ছিল মুজিববাহিনী, এদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার। এদের সবার হাতেই কম বেশি অস্ত্র ছিল, সবার ছিল যুদ্ধ করার ট্রেনিং। তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজারের মতো আগ্নেয়াস্ত্র। এছাড়াও পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে লুটকৃত অস্ত্র গোলাবারুদের পরিমাণও কম ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা বাদেও রাজাকার, আল বদর, আল শামস, বিহারীদের কাছেও অস্ত্র আর গোলাবারুদ ছিল। নতুন দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক।

মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের মানুষের হাতে ছিল বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, এই অস্ত্র পুনুরুদ্ধার করা সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়; Image source: dailyasianage.com

শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফিরে আসার পর তার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকেই অস্ত্র জমাদান শুরু করেন। তবে ঝামেলা বাঁধে অতি বামপন্থী আর রাজাকার সহ বিহারীদের নিয়ে। অতি বামপন্থীদের একাংশ তাদের হাতে থাকা অস্ত্র জমাদানে আগ্রহী ছিল না, তাদের মতে বাংলাদেশে বিপ্লব অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, এবং এই ধারণা থেকে অনেকেই সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে যায়।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘মর্নিং নিউজ’ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিশ মাসে রাজনৈতিক কারণে ছয় হাজারের বেশি অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল। সশস্ত্র হামলা, ডাকাতির সংখ্যা দেশজুড়ে বৃদ্ধি পায়। নতুন দেশে চাওয়া পাওয়ার মিল না হওয়া, খাদ্যের অভাব, চাকরি আর কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণ আর মধ্যবয়স্ক অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বজন হারানো বিপুল সংখ্যক মানুষের মানসিক সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করে, যার হিসেব কাগজে কলমে কোনোদিন লিপিবদ্ধ হয়নি। 

অন্যদিকে বাংলাদেশে থাকা পাঁচ লাখ বিহারীদের নিয়ে সরকার পড়ে বিপাকে। মূলত ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং আশপাশের রাজ্য থেকে পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নেয় বিহারীরা। ব্যবসা বাণিজ্য আর ক্ষুদ্র শিল্পে ভালো দখল ছিল বিহারী হিসেবে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীর। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাঙালীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতনের অভিযোগ উঠে বিহারীদের বিরুদ্ধে। তাই স্বাধীনতার পরে বাঙালীদের অনেকেই বিহারী জনগোষ্ঠীর উপরে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে। উভয় পক্ষের হাতে অস্ত্র, বিহারিদের হাতে বাঙালীদের স্বজন হারানোর বেদনা আর স্বাধীনতার আবেগ, উভয় পক্ষের টিকে থাকার লড়াই আর প্রতিশোধ পরায়ণতার এক অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়া ছিল বাঙালী আর বিহারিদের মাঝে। তাই শুরুতে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিহারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। বিহারীদের একটি বড় অংশকে অবরুদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়, এই জনগোষ্ঠীও পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে কিন্তু পাকিস্তান তাদের গ্রহণ করতে শুরু করে গড়িমসি। যে সমস্যার সমাধান আজ অবধি করা সম্ভব হয়নি।

১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের কৃষি একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তবে কালোবাজারি, চোরাচালানের ফলে তার সুফল পাওয়া হয়নি দেশবাসীর। দেশের নাজুক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশে গড়ে উঠে চোরাকারবারি চক্র। পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা যায় ১৯৭৪ সালে উৎপাদিত চালের প্রায় ১০ থেকে ২০ লাখ টন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পাচার হয়ে যায়, প্রধান রপ্তানি দ্রব্য পাটের ২০ শতাংশ অবৈধভাবে ভারতে চলে যায়। দেশে ব্যাপক আকারে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় আর অন্যদিকে একটি অসাধু চক্র ব্যাংকনোটের জালিয়াতি শুরু করে, যার খবর পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হয়, সব মিলিয়ে দেশের মানুষের উপর ভয়াবহ অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয় ।  

স্বাধীন বাংলাদেশে আঘাত হানে দুর্ভিক্ষ, সৃষ্টি হয় মানবিক বিপর্যয়; Image source: witnessbd.wordpress.com

স্বাধীন দেশ প্রাকৃতিক আর ভৌগলিক কারণেও কম হোঁচট খায়নি। ১৯৭৪ সালের বন্যা দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একদিকে বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে চলছে ভাঙ্গা গড়ার লড়াই অন্যদিকে বাংলাদেশের ১৭ থেকে ১৯টি জেলা প্লাবিত হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভোগান্তি শুরু হয়। নতুন দেশের রাস্তাঘাট নতুন করে নির্মাণের কাজ বিভিন্ন জায়গায় যতদূর হয়েছিল তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, সরকারি তথ্য অনুসারেই ১৯৭৪ সালের নভেম্বরের দুর্ভিক্ষে সাড়ে সাতাশ হাজার মানুষ মারা যায়। বেসরকারি হিসেবে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখের ঘরে। ১৯৭০ সালের সাথে তুলনা করলে ১৯৭৪ সালে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ৭০০-৮০০% বেড়ে যায়। দেশজুড়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাতায় দুর্ভিক্ষের খবর; Image source: nytimes.com

মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে ছিল এক ভগ্নস্তূপে। দেশের সর্বত্রই পাক হানাদার বাহিনীর রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তুপ, দেশে লক্ষ লক্ষ তরুণ বেকার, অনেকের হাতেই গোলাবারুদ আর অস্ত্র, অনেকেই পঙ্গু কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। হাজারো লক্ষ মানুষের বুকে স্বজন হারানোর বেদনা, নয়মাস শরনার্থী শিবিরে কাটিয়ে আসা মানুষের এক মুঠো ভাতের জন্য হাহাকার। এরমধ্যেও একদল সুযোগ সন্ধানী মানুষের লুটতরাজের চেষ্টা চারিদিকে। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৪ সালের মে মাসের মধ্যেই দেশে ৯৫৪০টি খুন আর ১২২৪৪টি রাহাজানির ঘটনা সরকারি সূত্র থেকেই জানা যায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতে পাড়ি জমানো শরনার্থীরাও দেশে আসতে থাকেন; Image source: Raghu Rai

লাখো শহীদের আত্মত্যাগে স্বাধীন হওয়া দেশে তখন চারিদিকে সংকট। খাদ্য নেই, সুপেয় পানি নেই, রাস্তাঘাট নেই, ব্রীজ কালভার্ট নেই, দেশের নাজুক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চলছে চোরাকারবারি। প্রশাসনিক দুর্বলতা আর সীমাহীন দুর্নীতির সাগরে ধুঁকে ধুঁকে চলা প্রশাসন বিদেশ থেকে অর্থ, ত্রাণ সাহায্য মানুষের কাছে যথাযথ ভাবে বিতরণ করতে পারছে না।

জাতীয় রাজনীতিতে নানা পরিবর্তনে বেদনাবিধুর সেই সময় আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ আর তার অর্থনীতির যাত্রা এখন শুধুই সামনের দিকে। একদম কবির কবিতার মতো করেই ধ্বংসস্তুপে আমরা ফুল ফুটিয়েছি,

“শহীদের পূণ্য রক্তে সাত কোটি
বাঙালির প্রাণের আবেগ আজ
পুষ্পিত সৌরভ। বাংলার নগর, বন্দর
গঞ্জ, বাষট্টি হাজার গ্রাম
ধ্বংস্তুপের থেকে সাত কোটি ফুল
হয়ে ফোটে। প্রাণময় মহৎ কবিতা
আর কোথাও দেখি না এর চেয়ে।”

ছাত্রলীগের ইতিহাস মানেই বাংলাদেশের ইতিহাস





তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় একঝাঁক সূর্যবিজয়ী স্বাধীনতাপ্রেমী তারুণ্যের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়া মহাদেশের ‘বৃহত্তম’ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭২ বছরের ইতিহাস জাতির মুক্তির স্বপ্ন, সাধনা এবং সংগ্রামকে বাস্তবে রূপদানের ইতিহাস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ  বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছিল। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জল ভূমিকা ছিল। বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল অনেককে। তারপর আমরা আমাদের ভাষা হিসেবে বাংলাকে পেয়েছি।
 
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন, যাতে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর ভ্যানগার্ড ছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে, তোলে যা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।
 
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি দিয়েছিলেন, যা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন বেগমান হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাহসী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
 
১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে বাংলার ছাত্রসমাজ সারাদেশে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে, যা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বাংলার ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন, যা ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিকে ত্বরান্বিত করে।
 
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তৎকালীন ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্রলীগ কাজ করত। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচিত করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্রলীগ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে, যার মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত হয়।
 
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী শহীদ হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদ-সহ তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
 
জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও যুক্ত করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। ৩০ লাখ শহীদদের রক্তের মধ্য দিয়ে লাল-সবুজের পতাকা আমরা পেয়েছি, যাতে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ একটি দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে।
 
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশ অনেক দূর পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন থেমে থাকেনি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষে ছাত্রলীগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
 
অতীতে বাংলাদেশে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণের নেতৃত্বে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় এবং শাখা কমিটি যেভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন একইভাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। যার ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচার সরকারের পতন হয় এবং গণতান্ত্রিক সরকারের উত্থান হয়। যাতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১/১১’র সময় শেখ হাসিনাসহ ছাত্র-শিক্ষক সবার মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যার ধারবাহিকতায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব রাজবন্দি মুক্তি পেয়ে ২০০৮ সালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষে কার্যক্রম শুরু হয়। যাতে প্রধান অন্তরায় ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সময় ছাত্রলীগ রাজপথ পাহারা দিয়েছিল, যাতে কোনো ধরনের সহিংসতা না ঘটে। ছাত্রলীগের শত শত ছেলের আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় এবং অনেকের বিচারের রায় বাস্তবায়ন হয়। অনেকের মামলা এখনো চলমান। আশা করি সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শতভাগ কলঙ্কমুক্ত হবে।
 
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষে ছাত্রলীগের সব নেতাকর্মী রাজপথে সাহসী ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রলীগের ইতিহাসে যেমনই হাজার হাজার যোগ্য নেতার জন্ম হয়েছে তেমনই কিছু সংখ্যক অযোগ্য নেতার জন্ম হয়েছে। যার কারণে মাঝে-মধ্যে বিতর্কিত হতে হয় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংঠনটিকে। তবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সময়োপযোগী নেতৃত্বে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অবিচল। ছাত্রলীগ সব ভুল সংশোধন করে আগামীদিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় কাজ করে গেলে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুন্ন থাকবে। ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটুকু প্রত্যাশা। 

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামীলীগের ভূমিকা



 ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬’র ৬ দফা এবং ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নেয় আওয়ামী লীগ। যার প্রতিফলন ঘটে ৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে। বাঙালি যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। আর এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ, জন্ম নেয় বাংলাদেশ।

৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধু মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবেই আবির্ভূত হননি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তিনি স্বীকৃত হন বাঙালি জাতির একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে। ৭০-এর নির্বাচনের গণম্যান্ডেট না থাকলে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের (১৯৭১) স্বাধীনতার ঘোষণা চিহ্নিত হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে, যে-পথ বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করে লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন।


বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগেও তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। সেদিন তিনি কী বলতে পারেন, সেই সম্বন্ধে দেশে-বিদেশে নানা জল্পনা-কল্পনা চলে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু ওইদিন তার ভাষণে সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন মর্মে খবর প্রকাশিত হয়। যেমন দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিনিধি ডেভিড লোশাক ঢাকা থেকে যে সংবাদ পাঠান তাতে বলা হয়, ‘Sheikh Mujibur Rahman is expected to declare Independence tomorrow’. ৬ মার্চ এই সংবাদ তাদের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণ ছিল বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এক যুগ-সন্ধিক্ষণ। সেদিনের ভাষণে বিগত ২৩ বছরে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের শোষণ ও জাতিগত-নিপীড়নের বিবরণ তুলে ধরে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন তিনি।

২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় মানব জাতির ইতিহাসে এক বর্বর গণহত্যা, যা ৯ মাস ধরে চলে। অপরদিকে সৃষ্টি হয় সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রতীক্ষিত ক্ষণ। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে যে সরকার গঠিত হয়, তা-ই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বিপুলসংখ্যক বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এই সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।

একটি নিয়মিত সরকারের মতো এর ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কেবিনেট সচিব ও অন্যান্য সচিব, স্থায়ী ও বেতনভুক্ত বেসামরিক-সামরিক সরকারি কর্মচারী। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে। প্রত্যেক সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। অন্য সরকারি কর্মচারীদের মতো তারাও ছিলেন বেতনভুক্ত। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সর্বাধিনায়ক বা কমান্ডার-ইন-চিফ। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাদের প্রধান।

সরকার বাংলাদেশকে ১১টি সামরিক সেক্টরে বিভক্ত করার পাশাপাশি সমগ্র দেশকে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করে রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে মাঠ পর্যায়ে বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা গড়ে তোলে। দেশের মুক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের অনুশাসন পালিত হয়।

মুজিবনগর সরকারের বৈধ ভিত্তি ছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ৭২.৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অর্জন করে (৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন)। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল আরও নিরঙ্কুশ। জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি (৭টি নারী আসনসহ) লাভ করে। এর মধ্যে ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে মাত্র ২টি হাতছাড়া হয়, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন অর্জন করে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদেও আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল অবিস্মরণীয়। ৩১০টি প্রাদেশিক পরিষদ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসন ও প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৮৯ ভাগ লাভ করে।

এই বিজয়ের ভিত্তিতেই ১০ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। এ সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। দিনটি ছিল শনিবার। বৈদ্যনাথতলার আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। প্রায় ১০ হাজার মানুষের বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগ চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলীর স্বাধীনতা সনদ পাঠের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।

এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাঠের মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তা সাংগঠনিক রূপ নেয়। শপথ অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলামী পার্টি এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) মোকাবিলা করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। কারণ, এসব রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। এ ছাড়া, চৈনিক বামরাও ছিল পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। তারাও রণাঙ্গনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সবদিক বিবেচনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ এককভাবেই নেতৃত্ব দিয়েছে। আর দেশের মুক্তিকামী জনগণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়ের লাল সূর্য।

কে থামাবে এদের?